সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব, সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভ্যতার সংকট এবং তা থেকে উত্তরণ সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা আলোচনা করা হল:
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে নিজের আশিতম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে পাঠ করার উদ্দেশ্যে সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন। এ প্রবদ্ধে লেখক ইউরােপীয় সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা ও তার মানবতাবিরােধী নিপীড়ন দর্শনে যেমন হতাশ হয়েছেন তেমনি আবার প্রাচ্য তথা ডারতবর্ষের জনসাধারণের নবজাগরণের প্রত্যাশায় বুক বেধেছেন। প্রবল প্রতাপশালী ইংরেজদের ক্ষমতা, মদমত্ততা ও আত্মন্ভরিতার দাপট শেষ হওয়ার দিন ঘনিয়ে এসেছে বলে তিনি চরম আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
পাশ্চাত্য সভ্যতা
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর যৌবনকালে মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় পেয়েছিলেন ইংরেজ চরিত্রে তথা পাশ্চাত্য সভ্যতায়। বিশ্ব সাহিত্যে সে সময় বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ছিল নিতান্ত কম। তাই ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যকে জানা ও তা উপভােগ করা ছিল মার্জিতমনা বৈদপ্ধ্যের পরিচয়। সে সময় বার্কের বাগ্মিতায় মেকলের ভাষা প্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে, শেক্সপিয়রের নাটকের উৎকর্ষতায় ও বায়রনের কাব্যের মহিমায় বিশ্বসংস্কৃতির দিনরাত্রি ছিল মুখরিত। ভারতবর্ষের বিদগ্ধ মানুষেরা সনাতনী ধ্যানধারণার নাগপাশ ছিন্ন করে ইংরেজি সাহিত্যের ভাবসম্পদ আত্মস্থ করায় মগ্ন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছিলেন তা ছিল পাশ্চাত্যমুখী। তাই তিনিও পাশ্চাত্য সাহিত্য ও সভ্যতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।
পাশ্চাত্য সভ্যতার নগ্নতা
ইংরেজরা ভারতবর্ষে এসেছিল বাণিজ্য করতে। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর ক্ষমতার মদমত্ততায় তারা মানবপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হলাে। এক সময় দেখা গেল সমস্ত ইউরােপে তাদের বর্বরতা নখদন্ত বিস্তার করে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে। এ মানবপীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভাতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ল। পাশ্চাত্য সভ্যতার এ নগ্নতা রবীন্দ্রনাথের কল্পনার বাইরে ছিল। যখন তিনি এর মুখােমুখি হলেন তখন চরম হতাশ হয়ে বলে উঠলেন- “জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম ইউরােপের অন্তরের সম্পদ এ সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলে হয়ে গেল।”
সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের বিষয়বস্তু
যে যন্ত্রসভ্যতার জোরে ইংরেজ জাতি নিজের কর্তৃত্ব সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল তারা সে যন্ত্রশক্তির যথােচিত ব্যবহার গেকে ডারতবর্ষকে বঞ্চিত করল। অথচ চোখের সামনে চীন ও জাপান তা ব্যবহার করে নিজেদের সমৃদ্ধি ঘটালাে। ইংরেজ ভারতীয়দের পদানত করে রাখার উদ্দেশ্যে ‘Law and order’ প্রতিষ্ঠা করে তার প্রয়ােগ নিশ্চিত করল। এর ফলে ভারতীয়রা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হলাে। ইংরেজ শাসনের জাতাকলে পিষ্ট ভারতবাসীর দারিদ্রোর যে নিদারুণ ছবি রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করলেন তা হৃদয়বিদারক। অথচ এ হতভাগ্য ভারতবর্ষ দীর্ঘকাল ধরে ইংরেজকে ঐশ্বর্য যুগিয়েছে। ইংরেজদের এই অকতজ্ঞতাকে লেখক ঘণা ও ক্ষোভের সাথে প্রত্যক্ষ করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজের অবিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানাে যে পাপ তা তিনি পুনর্ব্যক্ত করতে ভােলেননি। সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব লেখকের বিশ্বাসভঙ্গ যখন লেখক ইংরেজ চরিত্রে সাম্রাজ্য মদমত্ততার উপকরণ প্রত্যক্ষ করলেন তখন তাঁর বিশ্বাসভঙ্গ ঘটল।
তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিত রূপে স্বীকার করেছিল রিপুর তাড়নায়। তারা তাকে অনায়াসে লজ্ঘন করে গেল। তাই নিভতে ইংরেজি সাহিত্যের রসসন্ভোগের বেষ্টন থেকে একদিন তিনি বেরিয়ে এলেন। সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র্ তিনি প্রত্যক্ষ করলেন তা হৃদয়বিদারক। তিনি অনুভব করলেন, মানুষের জীবনধারণের যে অত্যাবশ্যক উপকরণ অনু, বন্ত্ৰ, শিক্ষা, চিকিৎসা সেসব থেকে ভারতীয়রা বঞ্চিত। এমন শাসনচালিত অন্য কোনাে দেশে এমন পকট রূপে দেখা যায়নি।
ইউরােপীয় সভাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব বঞ্চনা আধুনিক ডিগ্রি বাংলা (আবশ্যিক) ২২৭ লেখকের মােহমুক্তি : কৈশাের ও যৌবনে যে ইউরােপীয় সভাতার ঔদার্যে লেখক মােহাচ্ছন্ন ছিলেন জীবনের শেষপ্রতে পৌছে তিনি তার নগ্ন রূপটি প্রত্যক্ষ করে মর্মাহত হলেন। তিনি দেখলেন, যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ তার বিশ্বক্তৃ পরাতিটা করেছে তার যথার্থ ব্যবহার থেকে ভারতবর্ষ বঞ্চিত। অথচ একই যন্ত্রশক্তির সাহায্যে জাপানিরা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুনঃ পথ জানা নাই গল্পের মূলভাব
ইংরেজরা ভারতীয়দের পৌরুষ দলিত করে দিয়ে তাকে চিরকালের মত নির্জীব করে রেখেছে। অথচ এ দেশ ইংরেজকে বহুকাল ধরে এসথ জগিয়ে এসেছে। আর ভারতবর্ষ ইংরেজের সভ্য শাসনের জগন্ধল পাথর বকে চেপে ধরে তলিয়ে রয়েছে নিরুপায় নিশ্চলতার মধযে। ভারতীয়দের এ শােচনীয় দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে লেখকের মােহমুক্তি ঘটেছে। সভ্যতার সংকট থেকে উত্তরণে প্রাবদ্ধিকের আশাবাদ : মােহমত্তি ঘটার পর রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতের ভবিষ্যৎ চিন্তায় নিজেকে নিমগ্ন করেছেন। ভাগ্যচত্রের পরিবর্তনের স্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এ ভারতবর্ষ ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। কিন্তু সেদিন যে ভারতবর্ষকে তারা ফেলে যাবে তা এক লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবজনা স্তূপ মাত্র। তবুও ভেঙে পড়লে চলবে না। চরম আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি তাই বলেছেন,
“আজ আশা করে থাকব, পরিত্রাণকরতার জন্মদিন আসছে আমাদের এ দারিদ্রযলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শােনাবে এ পূর্বদিগন্ত থেকেই “
অর্থাৎ তিনি আশাবাদী ছিলেন যে, প্রাচ্যের এ দেশটি একদিন জেগে উঠবে এবং স্বাধীনতা অর্জন করে আপন ঐতিহ্যে মহিমান্বিত হবে।
নবজীবনের প্রত্যাশায় রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায় জন্রিত রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে নবজীবনের প্রত্যাশায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দিন একভাবে যাবে না। ইংরেজ শাসনের অবসান হব অচিরেই। বিশ্বাস হারানােকে তিনি পাপ বলে মনে করতেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন,
“মহাগ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তাে আরম্ভ হবে এ পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎমর্যাদা ফিরে পাবার পথে।
” কারণ, “প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমস্ততা আত্ম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে।”
মন্তব্য : সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব উপ্যুক্ত আলােচনাব প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইউরােপীয় সভ্যতার সম্রাজ্যবাদী নখাঘাতে জর্জরিত ভাবতবর্ষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, ভারতীয়দের নবজীবনের যে প্রত্যাশার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর মাত্র ছয় বছর পর সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল এবং ভারতীয়রা তাদের মর্যাদা ফিরে পেয়েছিল। সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব লেখক নবজীবনের যে প্রত্যাশা করেছিলেন তা আজ ফুলে-ফলে সুশােভিত হয়ে উঠেছে। আশা করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভ্যতার সংকট রচনাবলী নিয়ে আপনাদের সকল জটিল অজানা তথ্য গ্রহন করতে সক্ষম হয়েছেন।